বিগত শেখ হাসিনা সরকারের অনেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও এমপিও সুবিধাভোগী ব্যবসায়ীসহ প্রায় অর্ধশত ব্যাক্তির স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ একশ গুণ থেকে শুরু করে কয়েক হাজার গুণ বেড়েছে। দেশে শত শত একর জমি, বিপুল সংখ্যক ফ্ল্যাট ও শিল্প-কারখানার মালিক হওয়ার পাশাপাশি অনেকে বিদেশেও একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি কিনেছেন। অনেকের বিরুদ্ধে শত শত কোটি টাকা পাচারেরও অভিযোগ রয়েছে।
অপরদিকে এরই মধ্যে ৪১ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও এমপির দুর্নীতি অনুসন্ধান করতে সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী আবেদন করেন। অভিযোগের সঙ্গে ব্যারিস্টার এম সরোয়ার হোসেন দুদক চেয়ারম্যানের কাছে ৪১ জনের তালিকা ও তাদের সম্পদ বৃদ্ধির পরিসংখ্যান দেন। এতে তিনি গত ৫ থেকে ১৫ বছরে মন্ত্রী ও এমপি থাকা অবস্থায় এই ৪১ জনের সম্পদ বৃদ্ধির চিত্র তুলে ধরেন। এর পর থেকেই আওয়ামী লীগ সরকারের এই মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে দুদক অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দুর্নীতির অনুসন্ধানের ওই তালিকা থাকা ৪১ জনের মধ্যে ২৩ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবং ১৮ জন সংসদ সদস্য।
এ প্রসঙ্গে দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমিন বলেন, সাবেক মন্ত্রী, এমপিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে। দুদক কাউকে ছাড় দেবে না। কমিশনে অভিযোগ করে থাকলে কমিশন সেটি তার বিধি অনুযায়ী দেখবে, এটা কমিশনের নৈমিত্তিক কাজ।
দুদকের ঊর্ধ্বতন আরেক কর্মকর্তা ৪১ মন্ত্রী-এমপির দুর্নীতির অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, তিনজন পরিচালকের নেতৃত্বে আলাদা তিনটি টিম এই অনুসন্ধানের কাজ করবে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এম সরোয়ার হোসেনের দুদকে পাঠানো আবেদনে যেসব সাবেক মন্ত্রীর নাম রয়েছে তারা হলেন-টিপু মুনশি, নসরুল হামিদ বিপু, সাধন চন্দ্র মজুমদার, আনিসুল হক, ডা. দীপু মনি, ডা. এনামুর রহমান, জাহিদ মালেক, তাজুল ইসলাম, জুনাইদ আহমেদ পলক, মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, ফরিদুল হক, গোলাম দস্তগীর গাজী, ইমরান আহমদ, জাকির হোসেন, কামাল আহমেদ মজুমদার, জাহিদ আহসান রাসেল, নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, শাহজাহান খান, হাছান মাহমুদ, কামরুল ইসলাম, হাসানুল হক ইনু ও মহিবুর রহমান।
সাবেক সংসদ সদস্যদের মধ্যে এই তালিকায় রয়েছেন, বেনজীর আহমেদ (ঢাকা-২০), সরওয়ার জাহান (কুষ্টিয়া-১), শরিফুল ইসলাম জিন্না (বগুড়া-২), শহিদুল ইসলাম বকুল (নাটোর-১), শেখ আফিল উদ্দিন (যশোর-১), ছলিম উদ্দীন তরফদার (নওগাঁ-৩), কাজী নাবিল আহমেদ (যশোর-৩), এনামুল হক (রাজশাহী-৪), মামুনুর রশিদ কিরন ( নেনায়াখালী ৩), কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা (খাগড়াছড়ি), মেহের আফরোজ চুমকি (গাজীপুর-৫), কাজিম উদ্দিন আহমেদ (ময়মনসিংহ-১১), স্বপন ভট্টাচার্য (যশোর-৫), আনোয়ার হোসেন মঞ্জু (পটুয়াখালী-২), নূরে আলম চৌধুরী (মাদারীপুর-১), আবু সাইদ আল মাহমুদ স্বপন (জয়পুরহাট-২), শেখ হেলাল উদ্দিন (বাগেরহাট-১), জিয়াউর রহমান (চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২)।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর এর আগে দুই ডজন সাবেক মন্ত্রী, এমপি, আমলা, ব্যবসায়ী ও পুলিশের অনিয়ম-দুর্নীতির অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ইতোমধ্যে তাদের সম্পত্তি, নামে-বেনামে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকার পরিমাণ খোঁজ নিচ্ছে দুদক। এর মধ্যে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) তাদের সম্পদের তথ্য চাওয়া হয়েছে।
ইতোমধ্যে সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের স্ত্রী কাশমেরী কামাল, মেয়ে নাফিসা কামাল, ফেনী-২ থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী, ফেনী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী এবং ঢাকা-২০ আসনের সংসদ সদস্য বেনজীর আহমেদসহ তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য দুদকের উপপরিচালক মোহাম্মদ নূরুল হুদার নেতৃত্বে তিন সদস্যের অনুসন্ধান দল গঠন করা হয়েছে।
এ ছাড়া অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগে ডিবির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক। একই অভিযোগে ডিএমপির সাবেক কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়ার বিরুদ্ধেও অনুসন্ধান করছে এ সংস্থাটি। অন্যদিকে লন্ডনে বাড়ি নির্মাণের অভিযোগে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানের বিরুদ্ধে তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অপরদিকে বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার সালমান এফ রহমান, সাবেক বন ও পরিবেশমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন এবং সাবেক এমপি নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এ ছাড়া অনুসন্ধান শুরু হয়েছে আলোচিত সাবেক অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল, আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুস সোবহান মিয়া গোলাপসহ চার সাবেক এমপি, সমালোচিত ব্যবসায়ী এস আলম, ব্যবসায়ী সাইফুল আলম (এস আলম) ও পদ্মা ব্যাংকের পদত্যাগ করা চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাত, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সদ্য পদত্যাগ করা চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম, ঢাকা ওয়াসার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান, যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মজিবুর রহমান নিক্সন চৌধুরীর বিরুদ্ধে। দুদক সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) একাধিক প্রভাবশালীর সম্পদের তথ্য চাওয়া হয়েছে। আগামী সপ্তাহে এসব তথ্য পাওয়া গেলে আরও প্রভাবশালীর দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করতে পারে দুদক।
অপরদিকে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে লাল ফিতায় বন্দি ছিল দলীয় মন্ত্রী-এমপি-নেতাদের দুর্নীতির বড় বড় ফাইল। সেই সময়ে গণহারে মন্ত্রী-এমপি-নেতাদের দুর্নীতির অভিযোগ পরিসমাপ্তি করে ‘ক্লিনচিট’ বা দায়মুক্তি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এখন ওইসব মন্ত্রী-এমপি-সুবিধাভোগীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও সম্পদের অনুসন্ধান ফের সচল হচ্ছে।
এর আগে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তার পাঁচ সহযোগীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসে নিয়োগ বাণিজ্য করার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকের উপ-পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়েছে। অনুসন্ধান টিমে আরও রয়েছেন, দুদকের উপপরিচালক মুহাম্মদ জয়নাল আবেদিন, সহকারী পরিচালক আবুল কালাম আজাদ, মোহাম্মদ জিন্নাতুল ইসলাম ও মো. নাছরুলস্নাহ হোসাইন।
অনুসন্ধানে জানাগেছে, বিগত ১৬ বছরে নানা সময়ে গণমাধ্যমের চাপে কিংবা সরকারের সাময়িক ইশারায় কিছু ‘রুই-কাতলা’ ধরার কাজ শুরু করে দুদক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা জাল কেটে বেরিয়ে গেছে। এমনকি কেউ কেউ একাধিকবার অভিযোগ পরিসমাপ্তি করে ‘দায়মুক্তি’ নেন। ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা দুর্নীতিবাজদের নতুন করে অনুসন্ধানের আওতায় আনতে তালিকা করছে একটি সংস্থা। নতুন করে সাজানোর পরই এই তালিকা দুদকের হাতে তুলে দেয়া হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, তালিকা করতে গিয়ে তারা জানতে পেরেছেন, একজন ব্যক্তির অভিযোগ চারবার পরিসমাপ্তি করার ন্যক্কারজনক নজির স্থাপন করেছে দুদক। এই ব্যক্তি হলেন-ছাগলকাণ্ডে আলোচিত এনবিআরের সাবেক সদস্য মতিউর রহমান। আলোচিত ডায়মন্ড ব্যবসায়ী ও আওয়ামী লীগ নেতা দীলিপ কুমার আগরওয়ালার দুর্নীতির অভিযোগ দুবার পরিসমাপ্তি করা হয়েছে। দীলিপের বিরুদ্ধে ডায়মন্ডের কারবারে বিপুল সম্পদ গড়া ও বিদেশে অর্থ পাচারের তথ্য ওপেন সিক্রেট। তার ভারত ও অস্ট্রেলিয়ায় ডায়মন্ড জুয়েলারি শোরুম আছে। কিন্তু তিনি বিদেশে বিনিয়োগের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো অনুমোদন নেননি। দীলিপের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে বিদেশে শোরুমের তথ্য প্রকাশিত থাকলেও দুদক রহস্যজনক কারণে তার দুর্নীতির খুঁজে পায়নি।
সন্দ্বীপের আলোচিত ‘দুর্নীতিবাজ’ সাবেক সংসদ-সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতার দুর্নীতির অভিযোগ একাধিকবার পরিসমাপ্তি করে দুদক। অথচ স্থানীয় মানুষ প্রকাশ্যে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির এন্তার অভিযোগ করে। দেশে-বিদেশে তার বিপুল সম্পদের তথ্যও ওপেন সিক্রেট। অথচ দুদক তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে ‘দায়মুক্তি’ দেয়।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের দেড় বছরে দুদক থেকে দায়মুক্তি পেয়েছেন ৮ সংসদ-সদস্য। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের সংসদ-সদস্য নজরুল ইসলাম বাবু তার বিরুদ্ধে দুদফা দুর্নীতির অভিযোগের পরিসমাপ্তি করিয়ে ‘ক্লিনচিট’ নিতে সক্ষম হন। অথচ তার অবৈধ সম্পদের ফিরিস্তি ও তথ্যপ্রমাণসহ গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রচার-প্রকাশিত হয়েছে। সরকার পতনের আগেই অবস্থা বেগতিক দেখে বিদেশে পাড়ি জমান বাবু।
এছাড়াও জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ, চট্টগ্রাম-১২ আসনের সংসদ-সদস্য শামসুল হক চৌধুরী, ভোলা-৪ আসনের সংসদ-সদস্য আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব, কিশোরগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ-সদস্য আফজাল হোসেন, শেরপুর-১ আসনের সংসদ-সদস্য আতিউর রহমান আতিক ও সাবেক সংসদ-সদস্য সিরাজুল ইসলাম মোল্লা ও বিএম মোজাম্মেল হক দুদক থেকে ‘দায়মুক্তি’ পেয়েছেন। আর দুর্নীতির অভিযোগে ভোলা-৩ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ-সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন ও বরিশাল-৪ আসনের সংসদ-সদস্য পঙ্কজ দেবনাথ, রাজশাহী-১ আসনের সংসদ-সদস্য ও সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী ওমর ফারুক চৌধুরী, মাদারীপুর-৩ আসনের সংসদ-সদস্য মো. আবদুস সোবহান মিয়া গোলাপ ও মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে বিকল্পধারার সংসদ-সদস্য মাহী বি চৌধুরীর বিরুদ্ধে বছরের পর বছর ধরে দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান চলমান। এদের দুর্নীতির ফাইল এতদিন অচল থাকলেও এখন সচল হচ্ছে।
কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুদক ঢেলে সাজানো না হলে এসব কর্মকাণ্ড শেষ পর্যন্ত আগের মতোই ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’তে পরিণত হতে পারে মনে করছেন খোদ দুদক কর্মকর্তারা। তাদের ভাষ্য-কর্মকর্তাদের হাত-পা বেঁধে সাঁতার কাটতে নামায় কমিশন। ফলে বিগত দিনে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে খুব কম সংখ্যক অনুসন্ধান আলোর মুখ দেখেছে। বেশিরভাগ বড় বড় দুর্নীতির অভিযোগ রাজনৈতিক ও অনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে পরিসমাপ্তি করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুদক ঢেলে সাজানোর পরই দুর্নীতিবিরোধী কার্যকর অভিযান শুরু হবে। আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার পরিকল্পনাও নেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে এর আগে প্রভাব খাটিয়ে যেসব মন্ত্রী-এমপি, আমলা ও সরকারি কর্মকর্তা অভিযোগ পরিসমাপ্তি করে ‘দায়মুক্তি’ নিয়েছেন তাদের তালিকাও করা হচ্ছে।
জানা গেছে, গত কয়েক দিনে বছরের পর বছর আটকে থাকা বেশ কয়েকটি অনুসন্ধান প্রতিবেদনের সুপারিশ আমলে নিয়ে মামলার অনুমতি দিয়েছে কমিশন। সবশেষ গত বুধবার ডাক বিভাগের আলোচিত সাবেক মহাপরিচালক শুধাংশু শেখর ভদ্রের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। এই কর্মকর্তা ডাক বিভাগের নামে মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানি নগদ পরিচালনার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এটাসহ ডাক বিভাগের নানা দুর্নীতির ঘটনা তদন্ত দীর্ঘদিন হিমাগারে ছিল। সম্প্রতি তোড়জোড় শুরু হলে গত বুধবার শুধাংশু শেখর ভদ্র ও ডেপুটি পোস্টমাস্টার জেনারেল মোস্তাক আহমেদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এর আগের দিন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ডিপিএস আশরাফুল আলম খোকনের দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় সংস্থাটি। ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খানের দুর্নীতির অনুসন্ধান শেষে গত বছর প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা। সেই প্রতিবেদন আমলে না নিয়ে ‘কোয়ারি’ দিয়ে ফাইল ফেরত পাঠায় কমিশন। কোয়ারির নামে ফাইলটি চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই নিয়ে কানাঘুষা শুরু হলে অনুসন্ধান কর্মকর্তা সৈয়দ নজরুল ইসলাম গত মঙ্গলবার তাকসিম এ খানের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞার আবেদন করে বিষয়টি দৃশ্যপটে আনেন। এমন অনেক বড় দুর্নীতিবাজের ঘটনা নিয়ে গণমাধ্যমে আলোচনা হলেও অনুসন্ধান ধামাচাপা পড়ে ছিল। এখন সেগুলো গতি পাচ্ছে।
দুদকের পদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপকালে তারা প্রায় অভিন্ন তথ্য দিয়ে বলেছেন, গত ১৬ বছরে বড় দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে মামলা দূরের কথা, সরকার না চাইলে অনুসন্ধান শুরু করাই যেত না। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনুসন্ধান চালুর পর দুর্নীতির সুস্পষ্ট তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলেও অভিযোগ পরিসমাপ্তি করতে বাধ্য করা হয়েছে। বিশেষ করে দুদকের গোয়েন্দা ইউনিটে চাঞ্চল্যকর শত শত দুর্নীতির ফাইল চাপা পড়ে আছে। কর্মকর্তাদের ভাষ্য-চুনোপুঁটি ধরার ক্ষেত্রে দুদক স্বাধীন। কিন্তু রাঘববোয়াল ধরতে হাত বাড়াতেই পারেন না তারা। সরকারের বিরাগভাজন হওয়ায় মাঝেমধ্যে দু-চারজনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের নামে মিডিয়া ট্রায়াল করা হয়েছে। মিডিয়া থেমে গেলে দুদকের কাজও থেমে গেছে। দলীয় সরকারগুলো কখনো দুদককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয় না। এবার সত্যিকার অর্থে দুদককে স্বাধীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার সুযোগ এসেছে। এমন কাজ করতে হবে যাতে সরকার বদলালেও দুদক বদলাতে না পারে। রাষ্ট্রীয় স্বার্থের বাইরে ব্যক্তিস্বার্থে কেউ যেন দুদককে ব্যবহার করতে না পারে। প্রতিষ্ঠানটি যেন দুর্নীতিবাজদের কাছে আতঙ্কের নামে পরিণত হয়।
দুদক সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ছাত্র-জনতার আস্থা অর্জনে নির্ভয়ে কাজ করতে চায় দুদক। এতে দুদকের শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সবাই একযোগে দুর্নীতি নির্মূলে কাজ করবে। এজন্য বিগত সরকারের দুর্নীতিবাজ শীর্ষ আমলা-মন্ত্রী, এমপি, ব্যবসায়ীদের দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িতদের অনুসন্ধান শুরু করেছে সংস্থাটি।
আইনজীবীরা বলছেন, এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে আদালত আইনানুযায়ী সর্বোচ্চ সাজাই দিতে পারবে। একইসাথে অপরাধ ঘটানোতে সহায়তাকারী হিসেবে স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে এবং পরিবারের অন্যদেরও এই শাস্তি দেয়ার বিধান রয়েছে।
‘দণ্ডবিধির ১০৯ ধারা অনুযায়ী অপরাধ সংঘটনের সহায়তাকারী হিসেবে তাদেরকেও মূল অপরাধীদের মতোই শাস্তি দেয়ার বিধান রয়েছে, বলেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।
বাংলাদেশে অর্থ পাচার মামলার বিচার করা হয় ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী।
এই আইনে যে ব্যক্তি অর্থ পাচার করে সেই ব্যক্তি এবং সহায়তা বা ষড়যন্ত্রকারী প্রত্যেকেরই সমান সাজা সুনির্ধারিতভাবে বলা হয়েছে।
এতে সর্বোচ্চ সাজা ১২ বছরের কারাদণ্ড এবং ন্যূনতম চার বছরের কারাদণ্ড দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়াও অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির দ্বিগুণ মূল্যের সমপরিমাণ অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করার বিধানও রয়েছে। একইসাথে, দণ্ডিত ব্যক্তির সম্পত্তিও রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার বিধান রাখা হয়েছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অনৈতিক উপায়ে যারা অর্থ উপার্জন করেছেন তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই অভিযান পরিচালনা করতে হবে। অন্যায়কে অন্যায় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেই সঙ্গে অন্যায়কারীদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
এরই মধ্যে শীর্ষ কিছু দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তবে আরও বড় পরিসরে অভিযান চালানোর ঘোষণা আসতে পারে। সেনাবাহিনী ছাড়াও আরও চার সংস্থার সমন্বয়ে হবে বেশকিছু টিম। সারা দেশে চলবে অভিযান।
তবে এক এগারোর যৌথবাহিনীর অভিযান থেকে শিক্ষা নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকেরা। কারণ তখন বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রথম কথা হলো যে, অভিযান পরিচালনা করা হবে সেটি যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় হতে হবে। সঠিকভাবে ঘোষণা দিয়ে একাধিক সংস্থার সমন্বয়ে এই অভিযান পরিচালনা করা উচিত।
এতদিন ভিআইপি এসব দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস না পেলেও ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অনেকেই এখন এ ব্যাপারে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। নখ-দন্তবিহীন দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) অনেকটা নড়েচড়ে বসেছে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
* ফের চালু হচ্ছে হাসিনা সরকারের ‘দায়মুক্তি’পাওয়াদের দুর্নীতির ফাইল * অনেকের বিরুদ্ধে বিদেশে শত শত কোটি টাকা পাচারেরও অভিযোগ
অর্ধশত মন্ত্রী এমপি ব্যবসায়ীর দুর্নীতির অনুসন্ধান চলছে
- আপলোড সময় : ২৩-০৮-২০২৪ ১০:৪১:৪৪ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ২৪-০৮-২০২৪ ১২:১৩:১৫ পূর্বাহ্ন
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ